রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
রূপালী স্বাস্থ্য।।
বিয়ের কিছুদিন পরেই শ্বশুড়বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসতে হয়েছে রহিমাকে (ছদ্মনাম)। কি তার অপরাধ? তার অপরাধ হলো- সে হঠাৎ খিঁচুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়, মুখ দিয়ে লালা পড়ে। খিঁচুনির মধ্যে প্রস্রাব করে দেয়। আর কিছু বলতে পারে না।
এরকম অনেক রহিমার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। মুখ ও শরীরে বিভিন্ন জায়গায় থাকে আগুনের পোড়া দাগ ও আঘাতের ক্ষতচিহ্ন। পানিতে গোসল করতে গিয়ে অনেক রোগীর অনাকাঙ্খিত মৃত্যু ঘটে। কে তাদের খবর রাখে। পাড়া-প্রতিবেশিরা বলে আলগা দোষ, বাতাস লেগেছে অথবা জিনে ধরেছে। কারণ অসুখ হলে তো সবসময় থাকবে নিশ্চয় বাতাস লাগছে কারণ অমাবশ্যা পূর্ণিমায় বেড়ে যায় এরকম হাজারও ব্যাখ্যা থাকে ফকির-কবিরাজ, তাবিজ-কবজওলাদের কাছে।
সামাজিক কুসংস্কার
অনেকে মনে করে মৃগী রোগ একটি আছরের ব্যাপার, আলগা দোষের ব্যাপার, বাতাস লেগেছে, জিন-ভূতের ব্যাপার। এ রোগের কোনো সঠিক চিকিৎসা নেই। এই রোগীর লেখাপড়া, বিয়েশাদী, সংসার কিছুই হবে না।
অনেকে মনে করে মৃগী রোগ একটা প্রাকৃতিক অভিশাপ। ফলে রোগটি গোপন করে রাখে, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। কারণ তারা মনে করে, রোগটি জানাজানি হলে পরিবারের জন্য ক্ষতি হবে, মেয়েটির বিয়ে দিতে অসুবিধা হবে।
এরককম ধারণার বশবর্তী হয়ে চিকিৎসা না করিয়ে আরও ক্ষতি করা হচ্ছে। বিয়ের পর মেয়েটি যখন শশুরবাড়ি যায় এবং সেখানে এই রোগ আক্রমণ করে তখন মেয়েটির বিয়ে টিকিয়ে রাখাই দুষ্কর হয়ে পড়ে। সুতরাং রোগটি গোপন না করে চিকিৎসা করানোই উত্তম।
মৃগীরোগ কী?
মৃগীরোগ ব্রেইনের ১টি অসুখ; যা মাথায় কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্যের কারণে হয়। ছোট কোলের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ সবাই মৃগীরোগে আক্রান্ত হতে পারে তবে বাচ্চাদের মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়।
রোগের লক্ষণ
হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
শরীরে খিঁচুনি শুরু হওয়া
জিহ্বা ও দাঁতে কামড় লাগা
খিঁচুনির সময় প্রস্রাব-পায়খানা হয়ে যাওয়া
জ্ঞান হারানোর মুহুর্তে তার চারপাশের ঘটনা বলতে পারে কিনা এ বিষয়গুলো মৃগীরোগ নির্ণয়ে সহায়তা করে
খিঁচুনির পরে মাথাব্যথা, শুয়ে থাকা, কিছু সময় ধরে চুপচাপ থাকা
কয়েকটি উদাহরণ
১. হঠাৎ করে যেকোনো বয়সের একজন মানুষ অজ্ঞান হয়ে, চোখ-মুখ উল্টিয়ে ফেলল এবং তার সাথে সারাশরীরে ঝাঁকুনি বা খিঁচুনি শুরু হয়ে গেল। এসময় এটাও দেখবেন, উৎসাহী দুয়েকজন তার নাকের সামনে জুতা, স্যান্ডেল ইত্যাদি ধরছে।
২. কোনো শিশু হঠাৎ অন্যমনষ্ক হয়ে যায়। চোখের পাতা পড়ে না। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। বাবা-মা অনেকসময় ভাবেন এটা ছেলের কাব্যিক ভাব। ছেলে তার কবি হয়ে উঠেছে। কখনও হাতে কিছু থাকলে হঠাৎ করেই পড়ে যায়।
৩. আপাতত মানসিকভাবে সুস্থ একজন লোক হঠাৎ করে অস্বাভাবিক ব্যবহার শুরু করল। মুখভঙ্গির পরিবর্তনসহ অস্বাভাবিক হাঁটাচলা শুরু করল। আবোল-তাবোল কথা বলতে শুরু করল। আবার কয়েক মিনিট পর সুস্থ হয়ে গেল।
৪. এরকম দেখা গেছে পানিতে গোসল করতে গিয়ে খিঁচুনি উঠে ডুবে গেছে।
৫. কেউ কেউ বলে চোখেমুখে অন্ধকার দেখি, চোখে আলোর ঝিলিক দেখি এরপর আর কিছু বলতে পারি না। এরকম বিভিন্নভাবে মৃগীরোগী ডাক্তারের কাছে আসতে পারে।
কাদের মধ্যে বেশি হতে পারে?
ফেবরাইল সিজার
অতীতে বা বর্তমানে পরিবারের কারও এ রোগ থেকে থাকলে।
ব্রেইন টিউমার
হেড ইনজুরি
বুদ্ধি প্রতিবন্ধী
স্ট্রোক
শরীরে মিনারেল ও ভিটামিনের ঘাটতি
বড় অসুখ যেমন ডায়াবেটিস ইত্যাদি।
মৃগীরোগ উঠলে আশপাশের লোকদের করণীয়
মৃগীরোগীর মুখে অনেকেই চামড়ার জুতা, গরুর হাড়, লোহার শিক ইত্যাদি চেপে ধরে। এসব স্রেফ কুসংস্কার, এসবে আসলে কোন কাজ হয় না বরং ক্ষতিই হয়। মৃগীরোগ হঠাৎ শুরু হয়ে আবার এমনিতেই থেমে যায়। সাধারণত এ ধরনের অ্যাটাক আধা মিনিট বা ১ মিনিট থাকে। এজন্য কোন কিছু করার দরকার নেই, অনেকে অস্থির হয়ে রোগীর হাত-পা চেপে ধরে, মাথায় পানি দেয়, অস্থির হয়ে মুখে ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। আসলে এসব কিছুই করার দরকার নেই। রোগটা নিজে নিজেই থেমে যাবে। তারপর সাধারণত রোগী ঘুমিয়ে পড়ে। কারও কারও অবশ্য মাথাব্যথা হয়। তবে করণীয় হলো রোগটি যেমন করছে, করতে দেয়া। শুধু দেখতে হবে যে রোগীর আশপাশে ধারাল অস্ত্র, যন্ত্রপাতি, আগুন ইত্যাদি যেন না থাকে। যেন সে আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। জোরে ঠেসে ধরলেই বরং ক্ষতি হতে পারে। রাস্তার পাশে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া উচিত। যদি দেখা যায় যে ৫-১০ মিনিটেও খিঁচুনি থামছে না, বা পরপর, ঘনঘন আক্রান্ত হচ্ছে তবে রোগীকে কাছের হাসপাতালে বা ক্লিনিকে স্থানান্তর করা দরকার। যেখানে ডাক্তাররা সঠিক ব্যবস্থা নেবেন।
রোগীর জন্য পরামর্শ
নিয়মিত ওষুধ সেবন করুন
নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিন
সময়মত ঘুমান
উত্তেজনা প্রশমন করুন
পানিতে নামবেন না।
খিঁচুনির মাত্রা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসা পর্যন্ত আগুনের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন।
গাড়ি চালানো থেকে বিরতি থাকুন
গাছে উঠবেন না
ভ্রমণের সময় সাথে ওষুধ রাখুন
ধূমপান বর্জন করুন
রোগীর সাথে চিকিৎসকের পরামর্শের ফটোকপি ও বাসার ফোন নম্বর সার্বক্ষণিক সাথে রাখুন
সবশেষে সকলের প্রতি উপদেশ
সামাজিক কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে এসে নিয়মিত চিকিৎসা নিন সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন-যাপন করুন।
ডা: কে.এম. জাহিদুল ইসলাম
এমবিবিএস(ঢাকা), বিসিএস (স্বাস্থ্য)
এমএস (অর্থোপেডিক সার্জারী) অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ ও সার্জন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি হাসপাতাল) ঢাকা।